নিজস্ব প্রতিনিধি : অপরিণত বা কম ওজনের শিশুদের বেঁচে থাকার জন্য ইনকিউবেটরের মতো বিশেষ যত্নের সুবিধাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কিশোরগঞ্জে কোন ক্লিনিক বা হাসপাতালে নবজাতকের জন্য ইনকিউবেটর সাপোর্ট না থাকায় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশু মৃত্যুর হার।
এমনই এক হৃদয় বিদারক মর্মান্তিক ঘটনা কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি এলাকার প্রবাসী শুভ মিয়া- প্রথম সন্তানের মুখ দেখে আদর-যত্নে কোলে নিয়ে পিতৃত্বের স্বাধ গ্রহণ করে হাসি মুখে আবার পাড়ি দিবেন দেশের গন্ডি পেরিয়ে নিজের কর্মস্থলে। এদিকে শিশুটির দাদা-দাদি বংশের প্রথম নাতির আগমনে বাড়িতে সাজিয়ে রাখেন দুলনা-খেলনা সহ অসংখ্য উপকরণ। কিন্তু প্রবাসীর দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও সব আশা চুর্ণ-বিচুর্ন হয়ে নেমে আসে অন্ধকারের কালো ছায়া। গত ৩০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার স্ত্রীর আট মাসের নিয়মিত চেক-আপ ও পরামর্শের জন্য আসে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের খরমপট্টিস্থ ফাতেমা (রা) মা ও শিশু স্পেশালাইজড হসপিটালে। সেখানকার চিকিৎসক ডা. টি আর জয় কিছু পরিক্ষা-নিরীক্ষা করে বাচ্চার সমস্যা দেখিয়ে দ্রুত সিজারের পরামর্শ দেন, যথারীতি সন্ধ্যা ৬টায় নেওয়া হয় ওটিতে। এরপর থেকেই অন্ধকারের কালো ছায়া গ্রাস করতে থাকে নবজাতক শিশুটিকে, ওটির ভিতরের তথ্য গোপন করে স্বজনদের জানানো হয় বাচ্চা ভালো আছে, রাত ১০টার দিকে পরিচিত একজন চিকিৎসক জানান বাচ্চার অবস্থা ভালো না শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আপনারা ঢাকা অথবা ভাগলপুর নিয়ে যান। এ্যাম্বুলেন্স রেডি করে ভাগলপুর যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে এমন সময় এই ক্লিনিকের এক অনভিজ্ঞ নার্স এ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেনের নলটা চারবার চেষ্টার পর এমনভাবে নাকে প্রবেশ করায় নলের আঘাতে নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে বাচ্চাটির, তা দেখে কলিজা ফেটে যায় স্বজনদের, তবুও নিরব ভূমিকায় রওনা হয় ভাগলপুরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিপদতো আর পিছু ছাড়ছে না, জানাগেল যাত্রাপথে কটিয়াদি পর্যন্ত অক্সিজেন সাপ্লাই হয়নি, এভাবেই ভাগলপুর পৌঁছে রাতটুকু অতিক্রম করে সকালে একজন চিকিৎসক জানালেন দ্রুত ঢাকা অথবা ময়মনসিংহ নিয়ে যান। আবারও এ্যাম্বুলেন্সে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন, ময়মনসিংহের কাছাকাছি যেতেই বাচ্চাটি আর শ্বাস নিতে দেখা যায় না, অবশেষে ময়মনসিংহ হাসপাতালে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক বাচ্চাটিকে মৃত ঘোষণা করেন। এমনটির বর্ণনা দিয়ে বাচ্চার স্বজন রাকিবুল হকের অভিযোগ – আমরা সমস্যার কথা শুনে ঢাকা অথবা ময়মনসিংহের আগ্রহ দেখালে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করে জানান, ময়মনসিংহ নিতে যে সময় লাগবে তার আগেই এখানে ডেলিভারি হয়ে যাবে। তারা যদি তাদের ব্যাবসার চিন্তা নাকরে রিপোর্ট দেখে বাচ্চাটির চিন্তা করে ঢাকা অথবা ময়মনসিংহের পরামর্শ দিতেন তাহলে হয়তো বাচ্চাটিকে বাঁচানো যেতো।
ক্লিনিকের এই অনভিজ্ঞ নার্সের নলের গুতোগুতিতে রক্ত বের হয়ে শ্বাস বন্ধ হতো না। আমরা মনে করি, বাচ্চাটির মৃত্যুর জন্য এই কসাইখানার অনভিজ্ঞ ডাক্তার- নার্সরাই দায়ী।
তাছাড়া একি দিনে এই ক্লিনিক থেকে তিনটি বাচ্চাকে ময়মনসিংহ হাসপাতালে নেওয়া হয়, তারমধ্যে নিকলির আল আমিনের স্ত্রী তিন্নির সিজারিয়ান বাচ্চাটাও শনিবার সকালে মারা যায়, অন্য বাচ্চাটি করিমগঞ্জ উলুখলার বকুল মিয়ার ভাতিজীর ঘরের নাতি ময়মনসিংহ হাসপাতালে ৩/৪ দিন চিকিৎসা নিয়ে এখন বাসায় রয়েছে।
আমরা চাই আমাদের মতো আর কেউ যেন এখানে সেবা নিতে এসে সন্তানহারা না হন।
নিকলির আল আমিন অভিযোগ করে বলেন – হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে, তবুও আল্লাহ বলেছেন বান্ধা তুমি চেষ্টা করো। কিন্তু, ডাক্তারের কথায় আমরা চেষ্টাও করতে পারিনি। আমাদেরকে মা ও বাচ্চার জীবন ঝুঁকির ভয়ে ফেলে কৌশলে ২৫ হাজার টাকায় সিজার কন্ট্রাক ফাইলে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হই। ভিতরের ইতিহাস আর বললাম না, আমার বাচ্চাটিকে ময়মনসিংহ হাসপাতালে নিয়েও বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ময়মনসিংহ থেকে মৃত বাচ্চাকে বাড়িতে এনে দাফন করে ক্লিনিকে আসি আমার স্ত্রীর কাছে, এসে দেখি ৩২৫৮৫ টাকা বিল এসেছে। আমি গেলাম ম্যানেজারের নিকট, আমার সবকিছু জানার পর ফোনে কার সঙ্গে জানি কথা বলে জানান যা কন্টাক্ট ছিলো তাই দেন, এর বাইরে আমাদের কিছু করার নেই। আমি বিল পরিশোধ করে বের হই। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমার রোগীর এতো এতো সমস্যা জেনেও কেন ময়মনসিংহ অথবা ঢাকায় নেওয়ার কথা বলে নাই!! ওরাতো শুধু ওদের ব্যাবসাটাই করেছে, কে বাঁচবে মরবে এটাতো দেখছে না।
আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি কসাইখানা নামক চাকচিক্যময় ইসলামিক নামের এই শপিং মলে। আমি প্রশাসনের নিকট বলবো একটু নজর দিন, সেবার নামে মানুষ মারার ব্যাবসা বন্ধ করুন। পরিশেষে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করি এর প্রতিদান যেন আমি আখিরাতে পাই। আর এদের বিচার তুমি দুনিয়াতেই করে দেখাও।
স্বজনদের এসব অভিযোগ সম্পর্কে ডা. টি আর জয়ের নিকট জানতে চাইলে তিনি, সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন – কিশোরগঞ্জে আমরাই একমাত্র সঠিক ক্লিনিক সেবাটা দিয়ে থাকি। আমরা সিজার ডেলিভারিকে শুন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে চেষ্টা করছি। সর্বশেষ গত মাসেও আমাদের এখানে ২৪২ টি নরমাল ডেলিভারি হয়েছে, যা কিশোরগঞ্জের সকল ক্লিনিক মিলিয়েও এর সমান হবে না। জটিল কিছু ডেলিভারি থাকে যা সিজার ছাড়া সম্ভব হয়না, তেমনটাই ঘটেছে এই দুটো রোগীর ক্ষেত্রে। আমরা রোগীর সমস্যাগুলো পার্সেন্টেজ সহ সবকিছু বুঝিয়ে বলার পরেও তারা এখানে রোগী ভর্তি করে হাইরিস্ক ভন্ডে স্বাক্ষর করে। যার ডকুমেন্টস আমাদের এখানে রয়েছে। আমরা মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, কোন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীকে রাজি/খুশি করার জন্য না।
এসব অভিযোগ ও ইনকিউবেটরের ব্যাপারে জেলার সিভিল সার্জন ডা. অভিজিৎ শর্মার কাছে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের জানান – নবজাতক শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি থাকতেই পারে, তবে ঝুঁকির পরিমাণ বুঝে আগেই পরবর্তী ব্যাবস্থা গ্রহণ করলে পেরেশানি ও মৃত্যুর হার কমে আসবে। আর এ ব্যাপারে কেউ আমাদের নিকট অভিযোগ করলে অবশ্যই আমরা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবো। আর নবজাতক শিশুর জন্য ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে ১০টি ইনকিউবেটর বেড চালু রয়েছে।
সিভিল সার্জনের কথার সুত্র ধরে ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে ইনকিউবেটরের খোঁজে গেলে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. নূর মোহাম্মদ শামসুল আলম জানান- আমাদের এখানে কেন কিশোরগঞ্জের কোথাও ইনকিউবেটর নেই। আমাদের স্কেনো ইউনিটে যা আছে তা ইউনিসেফের দেওয়া ১৪টি ওয়ার্মআপ মেশিন, এটিতে শুধু নবজাতক শিশুদের সঠিক তাপমাত্রায় রাখা যায়। আইসিইউর কোন ব্যাবস্থা নেই। যদি কোনো হাসপাতালে ইনকিউবেটর সাপোর্ট না থাকে, তবে অবিলম্বে শিশুকে উন্নত সুবিধাযুক্ত বিশেষায়িত হাসপাতালে স্থানান্তর করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (KMC) পদ্ধতি সাময়িকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করলেও এটি কোনোভাবেই ইনকিউবেটরের পূর্ণাঙ্গ বিকল্প নয়।
Leave a Reply