আজ ১৫ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৩০শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

“যারা ফিরে এল না” আকতার জামিল-যুগ্মসচিব শিক্ষা মন্ত্রণালয়

(সেই সব শিশুর জন্য,যারা সকালটা শুরু করেছিল ইউনিফর্মে—কিন্তু শেষ করেছিল আগুনে।)

সকালে উঠেই আয়নায় তাকায় জুনায়েদ,
হাসিমুখে পরে স্কুল ড্রেস, আঁচড়ে নেয় চুল,
মায়ের হাতে টিফিন, গলায় আইডি কার্ড—
বাবার মোটরসাইকেলে বসে বলে,
“আজ ক্লাসে দেরি হবে না মা।”
সে জানত না, আজ সে ফেরার কোনো কথা রাখবে না।

পাশের ক্লাসে নুসরাত, বইয়ের পাতা উল্টায়,
তিন বোনের ছোট, নতুন জামায় সেজে আজ এসেছে কোচিংয়ে,
শরীরটা দুরন্ত, মনটা রঙিন,
হঠাৎ এক বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে জানালার কাচ,
আকাশ চিরে আগুন নামে শ্রেণিকক্ষে।

এক মা ছুটে চলে রাস্তার উপর,
হাতে মোবাইল, কপালে নিজের হাত,
“আমার ছেলে কোথায়? শুধু একটা বার দেখতে চাই…”
সেই মায়ের কণ্ঠ ফুঁড়ে আসে একটা জাতির কান্না,
আর কেউ কিছু বলতে পারেনা,
শুধু বাতাস ভারি হয়ে যায় চুপিসারে।

সেলিম ছুটে চলেন সাংবাদিকতার দায়ে,
রাস্তায় যানজট, কাঁটাতার, লোহার গ্রিল,
সব অতিক্রম করে পৌঁছে যান ধোঁয়ার ভেতরে,
সেখানে পড়ে আছে আধপোড়া এক জুতো—
অথচ ছোট্ট জিনিসটা এমন করে
একজন মানুষকে ভেঙে দিতে পারে, কে জানত!

সবুজ স্যার হাতে মাইক নিয়ে চিৎকার করেন,
“রক্ত দিন, শিশুদের বাঁচাতে রক্ত দিন!”
পাশেই এক বাচ্চার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে,
তবু তার চোখে তৃষ্ণা—
জল না, শুধু একটু বাঁচার।

একাদশের কাব্য তখন গেটে,
আচমকা বিস্ফোরণ, সবাই দৌড়ায়,
বন্ধুদের নাম চিৎকার করে ডাকে—
কেউ উত্তর দেয় না, শুধু আগুনের লেলিহান শিখা,
আর পোড়া মাংসের গন্ধে ঢেকে যায় আকাশ।

মাহরীন ম্যাডাম তখন ক্লাসরুমে,
বাচ্চাদের হাত ধরে বের করে আনেন,
একজন, দুইজন, দশজন… বিশজন—
শেষটায় নিজেই আগুনে আটকা পড়েন।
রাতে বার্ন ইউনিটে নিঃশব্দে চলে যান
একজন সত্যিকারের শহীদ শিক্ষক হয়ে।

ইউশা বলছিল মায়ের কোলে—
“মা, আমার সব জ্বলে…”
শুধু এইটুকুই বলার মতো শক্তি ছিল বাকি,
মা ফুঁপিয়ে কাঁদছিল,
কিন্তু তার কান্নাও পৌঁছায়নি হয়তো তার কানে।

দগ্ধ শরীরে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়ায় আরিয়ান,
ডাকে শুধু—”আম্মু, আম্মু”, কাঁদে প্রাণপণ।
কেউ ধরে না তার হাত, কেউ ছুটে আসে না সামনে,
ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি হয়ে থাকে তার শেষ আর্তনাদ,
অবশেষে কাঁদিয়ে চলে যায় সে-
আমাদের নির্বাক বিবেক ফেলে রেখে।

পাইলট তৌকির হয়তো বুঝেছিলেন,
এই যুদ্ধ বিমানটা আজ তার শেষযাত্রা—
তবু ঘনবসতি এড়িয়ে রাখতে চেয়েছিলেন জীবন,
চেষ্টা করেছিলেন—
তবু বিধ্বস্ত হয় শিশুদের ঠিক মাথার ওপর।

পুড়ে যাওয়া বই, ছিঁড়ে যাওয়া ব্যাগ,
ঝলসানো ইউনিফর্ম,
একটার পর একটা খালি বেঞ্চে শুধুই শূন্যতা—
সবচেয়ে ছোট মুখগুলো আজ স্থির,
এক জাতির স্বপ্নে আগুন।

জুনায়েদ ফিরে আসেনা, আসেনা আরিয়ান
ব্যাগে ডিম আর ভাত সাজায় না কেউ,
আমরা শুধু দাঁড়িয়ে দেখি,
এক পোড়া জুতোর পাশে পড়ে আছে
আমাদের পুরো বিবেক।

আকতার জামিল, যুগ্মসচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মুঠোফোন-০১৬৭০-১৯৫১৯৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category