স্কটল্যান্ড থেকে আবু মিরন : অভিবাসীদের প্রতি আরও কঠোর হচ্ছে যুক্তরাজ্য সরকার। যুক্তরাজ্য সরকারের প্রকাশিত ১২ মে ২০২৫ অভিবাসন সংক্রান্ত শ্বেতপত্রের মূল পয়েন্ট, বিশ্লেষণ ও উপসংহার সমূহ তুলে ধরা হলো যা নিম্নরুপ :
১. নেট মাইগ্রেশন কমবে:
এই নীতিগত দলিলটিতে রাজনৈতিক দিকও তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়েভেট কুপার বলেছেন যে অভিবাসনের সংখ্যা কমানো প্রয়োজন, যদিও কীভাবে এটি করা হবে তা স্পষ্ট করা হয়নি। স্টারমার “ওপেন বর্ডারস” নীতিকে রীতিমতো সমালোচনা করে বলেছেন, ২০২৩ সালে নেট মাইগ্রেশন ৯ লক্ষের ওপরে ছিল, যা জনসেবার ওপর চাপ তৈরি করেছে কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করেনি।
২. দক্ষ ভিসা নীতিতে কঠোরতা:
দক্ষ কর্মীদের জন্য ভিসা পেতে হলে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজন, তার মানদণ্ড কঠোর করা হচ্ছে। আগে RQF ৩ (A-লেভেলের সমান) হলে চলত, এখন তা বাড়িয়ে RQF ৬ (ডিগ্রি স্তর) করা হবে। তবে কিছু ক্ষেত্র, যেখানে দেশীয় কর্মীর ঘাটতি আছে বলে বিবেচিত হবে, সেখানে সাময়িকভাবে RQF ৩-৫ স্তরের চাকরির জন্য ভিসা অনুমোদিত হতে পারে, তবে তা সময়সীমাবদ্ধ হবে।
৩. সামাজিক সেবা খাতে ভিসা:
এই খাতেও দক্ষ ভিসা পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে, তবে এর বাইরেও ঘোষিত হয়েছে যে ২০২৮ সাল পর্যন্ত একটি “পরিবর্তনকাল” শেষে বিদেশ থেকে সামাজিক সেবার জন্য নিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদিও বলা হচ্ছে দেশীয় কর্মীদের জন্য এই খাতকে আকর্ষণীয় করে তোলার পরিকল্পনা আছে, তবু অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করছেন যে এতে জনবল সংকট আরও বাড়তে পারে।
৪. শিক্ষার্থী ভিসা
বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও নেট মাইগ্রেশন বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। যদিও এর আর্থিক গুরুত্ব (প্রায় £২০ বিলিয়ন বার্ষিক অবদান) স্বীকার করা হয়েছে, তথাপি সরকার নতুন নিয়ম আনছে। নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানে পড়তে এসে পড়াশোনার পর দেশে না ফেরার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে, ভিসা স্পনসর প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কঠোর মানদণ্ড চালু করা হচ্ছে। সংক্ষিপ্ত ভাষা কোর্সের মাধ্যমে আগত শিক্ষার্থীদের ভিসা প্রক্রিয়াও পর্যালোচনা করা হবে।
৫. ভাষা দক্ষতার শর্ত
ইংরেজি ভাষার দক্ষতার মানদণ্ড আরও কঠোর করা হবে। যারা ভিসা এক্সটেনশন বা স্থায়ী বসবাসের আবেদন করবেন, তাদেরকে ভাষার অগ্রগতি প্রমাণ করতে হবে। পাশাপাশি, আগত কর্মী বা শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তবয়স্ক নির্ভরশীলদেরও অন্তত প্রাথমিক ইংরেজি দক্ষতা দেখাতে হবে।
৬. স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন বিলম্ব
বর্তমানে ৫ বছর পর স্থায়ী বসবাসের আবেদন করা যায়, তবে এটি বাড়িয়ে ১০ বছর করা হবে। সমালোচকরা বলছেন, এতে নবাগতদের সমাজে
একীভূত হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
৭. অপরাধ ও বহিষ্কার যারা স্বল্পমেয়াদি ভিসায় এসে অপরাধে জড়ান, তাদেরকে বহিষ্কারের বিষয়টি আরও সহজ করা হচ্ছে। আগে কেবল এক বছর বা তার বেশি জেল হলে বহিষ্কারের বিবেচনা করা হতো; এখন যেকোনো অপরাধেই তা প্রযোজ্য হবে, বিশেষ করে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে। এছাড়া ইউরোপিয়ান মানবাধিকার কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৮ (পারিবারিক জীবনের অধিকার) কিভাবে প্রয়োগ হবে তা স্পষ্ট করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
৮. বাড়তি ফি নিয়োগকর্তারা যারা বিদেশি কর্মী নেন, তাদের জন্য ইমিগ্রেশন স্কিলস চার্জ ৩২% বাড়ানো হয়েছে (গবেষণা বিজ্ঞানীদের মতো কিছু পেশা বাদে)।
এই ফি ২০১৭ সালের পর প্রথম বাড়ানো হলো, এবং তা মুদ্রাস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
৯. ই-পরিচয় কার্ড বিদেশি নাগরিকদের আগমন পর্যবেক্ষণে আরও দক্ষতা আনতে, বর্তমানের বায়োমেট্রিক রেসিডেন্স পারমিট কার্ডের পরিবর্তে নতুন ইলেকট্রনিক পরিচয় ব্যবস্থা চালু করা হবে। এটি সম্প্রতি চালু হওয়া ই-ভিসা ব্যবস্থারই একটি সম্প্রসারণ।
উল্লেখিত নীতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ ও উপসংহার দেওয়া হলো।
বিশ্লেষণ: যুক্তরাজ্য সরকারের নতুন অভিবাসন নীতির লক্ষ্য মূলত অভিবাসনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনা এবং দেশীয় জনবলকে উৎসাহিত করা হলেও তা বাস্তব সম্মত নয়। নীতিমালাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো হলো:
১. দক্ষ কর্মী ও শিক্ষার্থী ভিসা সীমিত করা – এতে স্বল্পযোগ্যতাসম্পন্ন বিদেশি কর্মীদের জন্য ইউকে-তে কাজ করা কঠিন হবে, বিশেষ করে সামাজিক সেবার মতো খাতগুলোতে।
২. ভাষা ও স্থায়ী বসবাসের শর্ত কঠোর করা – এর ফলে যুক্তরাজ্যে দীর্ঘমেয়াদে থাকার ইচ্ছা থাকা ব্যক্তিদের ওপর অনেক অনেক অতিরিক্ত মানসিক চাপ পড়বে। স্থায়ী হবার আবেদনের জন্য দশ বছর অপেক্ষা সহজ কথা নয়।
৩. অপরাধের ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা – এটি একটি নিরাপত্তাবিষয়ক বার্তা দিচ্ছে, তবে মানবাধিকার নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে।
৪. ই-পরিচয় পদ্ধতি ও প্রশাসনিক ডিজিটালাইজেশন – অভিবাসন ব্যবস্থার আরো আধুনিকীকরণ ও নিরীক্ষার লক্ষণ বহন করে।
উপসংহার: এই নতুন নীতিমালা যুক্তরাজ্যের অভিবাসন ব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি “নিয়ন্ত্রিত ও দক্ষ অভিবাসন ব্যবস্থা” গঠনের চেষ্টা, যা দেশীয় কর্মী, নিরাপত্তা ও জনসেবাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তবে বাস্তবে অনেক খাতেই জনবল সংকট আরও প্রকট হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক সংহতি ও বৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিগত দিনে লেবার পার্টি আভিবাসীদের প্রতি যে পরিমান সদয় ও সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে গতকালের আভিবাসন নিতীমালা সংক্রান্ত নেয়া সিদ্ধান্ত গুলো ঠিক যেন তার উল্টো। আভিবাসীদের প্রতি কনজার্ভেটিভ পার্টি আর লেবার পার্টির দৃষ্টি এখন সমান্তরাল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেবার পার্টি কনজার্ভেটিভ পার্টির চেয়েও বেশি কঠোর।
স্কটল্যান্ড এ বসবাসরত অভিবাসীদের উচিৎ স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী দলকে সহায়তা করা।
Leave a Reply