জাফরাবাদ ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সেনা বাহিনীর নিকট একাধিক অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিনিধি : কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জাফরাবাদ ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা প্রণব কান্তি ঘোষ এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির ও ঘুষ বানিজ্য উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর করিমগঞ্জ ক্যাম্প কমান্ডার বরাবরে একাধিক লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ইউনিয়নবাসী।
গত ২০ আগষ্ট সাধের জঙ্গল গ্রামের মো: মতিউর রহমান, ২১ আগষ্ট ক্বর্শা খালপাড় গ্রামের মো: ফজলুর রহমান ও ২২ আগষ্ট সাধের জঙ্গল গ্রামের মো: আবুল কালাম আলাদা আলাদা তিনটি লিখিত অভিযোগ করেন।
অভিযোগে মতিউর রহমান উল্লেখ করেন, আমি একজন দরিদ্র্য অসহায় দিনমজুর। গত ১৪/১০/২০২৩ ইং তারিখে আবেদন (নামজারি ও জমাখারিজ) নং ৭৮১৫১০৫। নামজারি ও জমা খারিজ মোকদ্দমা নং- ১৯২২ (৯-১) ২৩-২৪ মূলে নিজ নামে খারিজের আবেদন করি। যার মৌজা বাদেশ্রীরামপুর, খতিয়ান নং- ২১৩, দগ নং- ৫৭৭, পরিমাণ সাড়ে ৪ শতাংশ। উক্ত জমা খারিজের জন্য দায়িত্বরত ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা প্রণব কান্তি ঘোষ আমার নিকট নামজারি ও জমাখারিজ নিষ্পত্তির জন্য ৩০,০০০/- (ত্রিশ হাজার) টাকা দাবি করেন। আমি আমার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে জমি বিক্রির টাকা থেকে ১৫.০০০/- (পনের হাজার) টাকা নগদ প্রদান করি। কিন্তু দাবীকৃত সম্পুর্ন টাকা না দেওয়ায় আমার নামজারি ও জমাখারিজ অন্য কারন দেখিয়ে বাতিল করে দেয়। পরবর্তীতে আবার আবেদন করি যার নামজারি ও জমাখারিজ আবেদন নং- ৯৭৭৬৭৭০ তারিখ- ৩০/০৬/২০২৪ মোকদ্দমান নং- ২৪(৯-১) ২৩-২৪। উক্ত নামজারির জন্য আরো ৫০০০/- (পাঁচ হাজার) টাকা দেওয়া হয়। উক্ত নামজারি ও জমাখারিজটিও নামঞ্জুর করে তিনি বলেন, পুরো টাকা পরিশোধ না করলে খারিজ হবে না। আমার জানামতে আরো অসংখ্যা ভুক্তভোগী রয়েছে। যারা দিনের পর দিন টাকা দিলেও ভূমি সেবা পাচ্ছেন না। বরং হয়রানির স্বীকার হচ্ছে। তারপর আমি আমার পাওনা টাকা ফেরত চাইলে উনি টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করেন।
মো: ফজলুর রহমান উল্লেখ করেন, আমি একজন অসহায় খেটেখাওয়া লোক। মৌজা বাদেশ্রীরামপুর, আমার দাগ নং- ৪১২ এর পরিবর্তে আমাকে ৪১৩ নং দাগে প্রণব কান্তি ঘোষ দখল বুঝাইয়া দেয়।
এই ভূল সংশোধন করতে ভূমি অফিসে গেলে কোনো পাত্তাই দেয় না। কিন্তু টাকা দিলে সব ঠিক করে দিবে জানান, আর না হলে অফিসে আসার জন্য বারণ করে।
মো: আবুল কালাম লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, আমি একজন দারিদ্র্য অসহায় দিনমজুর। আমি পৈত্রিক ওয়ারিশি সূত্রে মৌজা বাদেশ্রীরামপুর, আরএস খং নং- ৬৫, দাগ নং- ৪১২ প্রাপ্ত হইয়া দীর্ঘদিন ধরে ভোগ দখল করিতেছি।
কিন্তু, ভূমি কর্মকর্তা প্রণব কান্তি ঘোষ টাকার বিনিময়ে আমার জমি গত ০৪/০৯/২০২৩ তারিখে ৫১৮নং খতিয়ানে অন্য লোকের নামে জমাখারিজ করে দেয়। আমি জমিতে এখন খাজনা দিতে পারি না। প্রণব কান্তি ঘোষের কাছে গেলে আমাকে ধমক দিয়ে অফিস থেকে বের করে দেয়।
এমন অলিখিত বহু মানুষের অভিযোগ, সরকারের নির্ধারিত ফি’র বাইরে অতিরিক্ত টাকা ঘুষ আদায় করছেন নায়েব প্রণব কান্তি ঘোষ।
তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশ সরকার ভূমির নামজারির ফি ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করলেও তিনি সর্বনিম্ন ৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছেন। আর অশিক্ষিত মানুষের কাগজপত্রে ত্রুটি না থাকলেও তিনি ভুল-ভাল বুঝিয়ে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আদায় করছেন বলে এমন অভিযোগ অনেকের।
জাফরাবাদ ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান আবু সাদাত সায়েম বলেন, উনার অফিসটা আমার পরিষদের মধ্যে হওয়ায় প্রতিদিনই কোন না কোন অভিযোগ নিয়ে লোকজন আমার কাছে আসে, কিন্তু আমার কিছুই করার থাকে না, নীরবে সহ্য করতে হয় আমাকে। আমি যতটুকু জানি, তিনি জাফরাবাদ ভূমি অফিসে ২০২০ সালে যোগদান করার পর প্রথম ৩ মাসের মধ্যে শুধু জমির নামজারিতে ঘুষ-বাণিজ্য করেছেন প্রায় ৩ লাখ টাকা। এখন তার মাসিক ঘুষ-বাণিজ্যের টাকার পরিমাণ প্রায় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। সামান্য ভুল থাকলেও জমির মালিকদের কাছ থেকে নিজে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন। কেউ টাকা না দিলে তিনি কোনো কাজই করেন না এবং কাগজপত্র তালাবদ্ধ করে রেখে দেন। ভূমি উন্নয়ন কর গ্রহণে তিনি কয়েক গুণ টাকা নিয়ে থাকেন। এই ভূমি অফিসের চৌকাঠ পেরুলেই ভূমি কর্মকর্তা প্রণব কান্তি ঘোষের নিজের করা আইন মানতে হয় সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষকে।
তাছাড়া, ভূমি অফিসে নামজারি, জমিভাগ, খাজনা আদায়, জমির পর্চা (খসড়া) তোলাসহ সব কাজে সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে অনৈতিকভাবে বাড়তি টাকা নিচ্ছেন তিনি। চুক্তির টাকা ছাড়া কোনো ফাইলই নড়ে না। তার দুর্নীতির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন ভূমি মালিকরা। আমি উর্ধতন কর্মকর্তার নিকট তার এসব কর্মকাণ্ডের জন্য বদলি চাই না, আইনানুগ ব্যবস্থায় শাস্তি দাবি করি।
একাধিক স্থানীয়রা জানান, তিনি রাতে অফিস করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আর এই অফিস করার আড়ালে নারীদের নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করেন তিনি, গত বছর নিজ অফিসে নারী কেলেংকারী ঘটনায় ধরাও পড়েন, এ ঘটনায় স্থানীয় লোকদের ম্যানেজ করে মারধোর ও আইনের হাত থেকে রক্ষা পায়।
রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমার ক্রয়কৃত খারিজ করা জমি আমার নামে জমির নামজারি করতে গিয়ে অনেক বিড়ম্বনার শিকার হয়েছি। এটা একদম সহজ কাজ খারিজ টু খারিজ, পুর্বের কিছু লাগে না। তাছাড়া সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও তাকে অনেক আগের মালিকদের ওয়ারিশ সনদ এনে দিতে বলেন, অন্যতায় নগদ ৫০ হাজার টাকা খরচ দিলেই সম্ভব হবে। এসব প্রস্তাব শুনে আমি আমার ফাইল ফেরত নিয়ে আসি। যার কারণে আর নামজারি করা হয়নি।
জানা যায় ভূমি কর্মকর্তা প্রণব কান্তি ঘোষের বাড়ি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নে, বর্তমানের তিনি শহরের বত্রিশ এলাকায় বসবাস করেন। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ায় বিগত ক্ষমতাসীন আওয়ামী দলের প্রভাব খাটিয়ে, স্থানীয় এবং শহরের নেতা ও সাংবাদিকদের নাম ব্যাবহার করে দাপটের সাথে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী সব জায়গায় অনিয়ম দুর্নীতি করে গেলেও কেউ কোন প্রতিবাদ বা কথা বলতে সাহস করেনি। কিন্তু গত ৫ আগষ্টে ছাত্র- জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর এখন তার শাস্তির দাবিতে সোচ্চার এলাকাবাসী।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, ভূমি কর্মকর্তা প্রণব কান্তি ঘোষ স্থানীয় কয়েকজন নারী পুরুষ দিয়ে উনার পক্ষে সাফাই শুনান এবং আনীত অভিযোগগুলো সম্পুর্ন মিথ্যা ও বানোয়াট উল্লেখ করে বলেন – মতিউর রহমান এর জায়গাটি তার দখলে নাই। সেনাবাহিনীর নিকট যে অভিযোগ দেয়া হয়েছে সেনাবাহিনী তা তদন্ত করে ব্যাবস্থা নেউক। আর আপনারাও আমার বিরুদ্ধে নিউজ করতে পারেন। আমার কোন ভয় নেই, আমি সততার সহিত দ্বায়িত্ব পালন করি, এজন্যই আমার শত্রু বেশি।
করিমগঞ্জ উপজেলার নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানা আলী বলেন, সেপ্টেম্বর অক্টোবর এর আগের কোন অভিযোগ সেনা বাহিনী আমাদের কাছে দেয়নি। ভূমি কর্মকর্তা প্রণব কান্তি ঘোষ এর বিরুদ্ধে যদি এমন কোনো অভিযোগ থেকে থাকে, তাহলে তদন্তের মাধ্যমে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।
Leave a Reply