নিজস্ব প্রতিনিধি : কাগজপত্রে বিতরণ থাকলেও দেখা মেলেনি মাঠে। প্রকৃত কৃষকের বদলে অন্যকে যন্ত্র দেওয়া, যন্ত্র বিতরণে হস্তক্ষেপ এবং ভর্তুকির যন্ত্র ছাড়িয়ে সামান্য মুনাফায় অন্যত্র বিক্রি ও কৃষকের নামে বরাদ্দকৃত কৃষি যন্ত্রের টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগ উঠেছে, ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এসব অনিয়ম দুর্নীতির কারণে ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের নেওয়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প। এতে কৃষকের পরিবর্তে লাভবান হচ্ছে কিছু অসাধু চক্র। সচেতন মহল বলছেন, প্রকল্প পরিচালনায় নানা অনিয়মের ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি।
তালিকায় তথ্য বিভ্রাট বিষয়ে জানতে চাইলে ইটনা উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মাহবুব ইকবাল জানান, তালিকায় যাদের নাম আছে সবাই মালামাল পেয়েছে আমাদের হাতে প্রমাণ আছে। তবে তথ্য ভিভ্রাটের বিষয়ে সদুত্তোর দিতে পারেননি এই কর্মকর্তা।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জ্বল সাহা বলেন – তালিকা অনুযায়ী সরকারের ভর্তুকির কৃষি যন্ত্রপাতি শতভাগ স্বচ্ছতার সহিত বিতরণ করা হয়েছে। তবে কোথাও কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তা দেখে ব্যাবস্থা নিবো।
কিন্তু, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জ্বল সাহার কথা ও তালিকাভুক্ত মাঠ পর্যায়ে কৃষকের বক্তব্য সম্পুর্ন বিপরীত। যেমন, উপজেলার চৌগাংগা ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম জানান, কৃষি যন্ত্র সুবিধাভোগী কৃষকের তালিকায় কেমনে আমার ছেলের নাম ও আমার মোবাইল নাম্বার ব্যাবহার করা হয়েছে জানিনা, আমার ছেলে যদি কোন মেশিন-টেশিন পাইতো তাহলে আমিতো জানতাম, আমি একটি হারভেস্টার মেশিনের আবেদন করেছিলাম কিন্তু কোম্পানি মেশিন দিতে পারেনি আমিও আর মেশিন পাইনি। আমার ছেলের কথা বাদেই দিলাম আমার ইউনিয়নের কেউ পেয়ে থাকলেও আমি জানার কথা।
একি ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম অপুও একি মন্তব্য করে বলেন – আমাদের ইউনিয়নে যাদের নাম তালিকায় আছে, তাদের একটি মেশিনও কেউ দেখাতে পারবেনা। মাঠকর্মী ইকবাল ও কৃষি অফিসার মিলে কাগজে পত্রে ও ফটোসেশানের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকের বরাদ্দ লুটপাট করে যাচ্ছে। আমি তদন্ত সাপেক্ষে এদের বিচার দাবি করছি।
সুবিধাভোগীর তালিকায় স্বপন মিয়া জানান, আমার নামে মেশিন দেওয়া হয়েছে তা আজ আপনাদের মাধ্যমে জানলাম। আমি ২০২০ সালে আবেদন করেছিলাম এরপর আর কিছুই জানিনা বা কেউ কিছু জানায়নি, আমার মতো এমন অনেক কৃষক আছে যাদের নাম ব্যাবহার করে মাঠকর্মী ইকবাল ও কৃষি অফিসার মিলে লুটপাট করছে।
জয়নাল আবেদীন নামে একজন অভিযোগ করে বলেন কৃষি অফিসার হিন্দু সম্প্রদায়ের হওয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী দলের প্রভাবে এবং ইকবাল স্থানীয় অফিসার হওয়ায় বিগত দিনে নেতাদের ম্যানেজ করে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী সব জায়গায় অনিয়ম দুর্নীতি ও লুটপাট করেছে, আমরা প্রকৃত কৃষক তার কাছ থেকে বিন্দু পরিমাণ সুযোগ সুবিধা বা পরামর্শ পাইনি। আমরা ১২ মাস কৃষি কাজ করেও কোনো মেশিন পাই না। আমরা কৃষি অফিসে গেলে বলে মেশিন নেই। আর মেশিন পায় যারা কোনোদিন কৃষি কাজও করে না অথবা তাদের জমিও নেই।
সরকারি নিয়ম হচ্ছে, বরাদ্দ হওয়া কৃষি যন্ত্র সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা তদারকি করবে একটি কমিটি। জেলার প্রতিটি উপজেলায় এমন কমিটি থাকলেও, মাঠ পর্যায়ে তদারকি নেই কমিটির। প্রতিটি যন্ত্র সুবিধাভোগীর কাছে অন্তত তিন বছর থাকা বাধ্যতামূলক এবং কোথাও হস্তান্তর বা বিক্রিযোগ্য নয়। জেলার ইটনা উপজেলা কৃষি অফিসের যন্ত্র বিতরণ তালিকা অনুযায়ী দেখা যায়, ২০২২ -২৩ ও ২৪ অর্থবছরে ইটনা উপজেলায় ৭৫ টি কৃষি সহায়ক যন্ত্র দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ২৭টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার, ১০টি সিডার (জমি চাষ ও বীজ রোপণ করার যন্ত্র), ১০টি পাওয়ার থ্রেসার, ৩টি রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, ৮টি পটেটো ডিগার, ৪টি রিপার বাইন্ডার ও ১৩টি মেইজ শেলার।
যার আনুমানিক বাজার মুল্য সর্বমোট সাড়ে ৮ কোটি টাকা।
যা হাওর এলাকার জন্য অন্তত ৭০ ভাগ ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে একটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার বরাদ্দ নিয়েছেন। এর অনুকূলে সরকারের ভর্তুকি দিতে হয়েছে ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং কৃষকের ব্যয় হয়েছে ৯ লাখ ৩০ হাজার (৩০%) টাকা। তবে কৃষকের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি যন্ত্রটি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে, এ সময় যন্ত্রটির খোঁজ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যন্ত্রটি আমার নামে কৃষি অফিস থেকে ছাড়িয়ে এক আত্মীয় নিয়ে গেছে। আমি এই যন্ত্র কখনও বাড়িতে আনিনি।
কৃষি অফিসের বিতরণ তালিকা অনুযায়ী বড়িবাড়ি ইউনিয়নের শিমুলবাক গ্রামের মহিউদ্দিন নামে একজন বলেন, আমি ১৯৯৬ সনে নদী ভাঙনের পর থেকে তাড়াইল উপজেলায় নানার বাড়ি গজারিয়া গ্রামের ভোটার হিসেবে বসবাস করছি। কিন্তু ইটনা উপজেলায় আমার তথ্য ব্যাবহার করে কে বা কারা মেশিন নিয়েছে তা আমি কেমনে বলবো।
এমন অভিযোগ বা তথ্যে অনিয়ম একটি দুটি নয়, ভর্তুকির যন্ত্র বিক্রি বা হাত বদলের উদাহরণ উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে অধিকাংশ যন্ত্রের ক্ষেত্রেই এমন অবস্থা বলে দাবি করেছেন প্রকৃত কৃষকরা।
সচেতন মহল বলছেন, কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নের স্বার্থে সরকার যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তা কিছু অসাধু, প্রভাবশালী এবং সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সরকারের এ সহায়তা নিচ্ছে যারা কখনও কৃষি কাজে জড়িত নয় অথবা কালোবাজারে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে একটি অসাধু চক্র। তাই এ ব্যাপারে আরও নজরদারি প্রয়োজন।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ অনেকের সুপারিশে এসব যন্ত্র বিতরণ করতে হয়েছে। এ কারণে মেশিন প্রকৃত কৃষক পাচ্ছে না
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, বিষয়টি আমি নিজে যাচাই করবো, আমি এখানে আসার আগে যন্ত্রপাতি গুলো বিতরণ করা হয়েছে। তবে, কিভাবে বিতরণ করা হয়েছে এ বিষয়টা আমি দেখবো। সরকারের এসব ভর্তুকির যন্ত্র বিতরণে কোন অনিয়ম কোথাও বিক্রি অথবা হাত বদলের সুযোগ নেই। অভিযোগের সতত্যা পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Leave a Reply