নিজস্ব প্রতিবেদক : পুর্ব বাংলার মহাবীর বার ভূঁইয়ার অন্যতম মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁ’র ৪২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী মঙ্গলবার। ১৫৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আজকের এই দিনে বৃহত্তর ভাটিরাজ্যের অধিপতি মসনদণ্ডই-আলা ঈশা খাঁ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুরদুর্গে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
এই বীরের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়িতে বীর ঈশা খাঁ স্মৃতি পাঠাগারের আয়োজনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচীতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে মঙ্গলবার বাদ যোহর ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়ি ঈশা খাঁ শাহী মসজিদে দোয়া, বিকেলে জঙ্গলবাড়ি হাবেলিতে ঈশা খাঁর বংশধরগণ, লেখক সাংবাদিক জনপ্রতিনিধি ও ভক্তদের নিয়ে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বীর ঈশা খাঁ স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি আমিনুল হক সাদী।
লেখক ও সংগ্রাহক আমিনুল হক সাদীর ‘ভাটিরাজ্যের অধিপতি মহাবীর ঈশা খাঁ ইতিহাসে উপেক্ষিত’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ১৫৩৬ মতান্তরে ১৫৩৭ সালের ১৮ অক্টোবর মতান্তরে ২৫ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলে রাজা কালিদাস গজদানী সিংহ নামান্তরে সোলায়মান খাঁর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন এই মহাবীর। তিনি প্রথমে সরাইলে পরবর্তীতে সোনারগাঁওয়ে রাজধানী স্থাপন করে পুর্ব বাংলার শাসক ছিলেন। ১৫৮৬ সালে বৃহত্তর ভাটিরাজ্যের অধিপতি মসনদণ্ডই-আলা ঈশা খাঁ কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার জঙ্গলবাড়িতে আগমণ করেন এবং তথায় বৃহত্তর ভাটি রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। ১৫৯৯ খিস্ট্রাব্দের দিকে ঈশা খাঁ কিছুদিনের বিশ্রামের জন্য সোনারগাঁও থেকে মহেশ্বরদী পরগণা বর্তমান গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর গ্রামের বক্তারপুর দুর্গের প্রাসাদভাটিতে গমণ করেন। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে শারিরিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে যান। রাজকীয় চিকিৎসায় অবিরাম চেষ্টা করেও তাকে সুস্থ করে তুলতে ব্যর্থ হন। এই অবস্থায় ১৫৯৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বৃহত্তর ভাটিরাজ্যের অধিপতি মসনদণ্ডই-আলা ঈশা খাঁ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুরে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।
বীর ঈশা খাঁ বিদেশীদের হঠাতে ও মুঘলদের নাস্ত্যানুবাদ করতে বাংলায় শক্তিশালী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। তৎকালে ভাটি রাজ্যের একজন অত্যাচারী শাসক হিসেবে সুসংরাজ জানকি নাথ মল্লিকের পুত্র লক্ষন হাজরা জঙ্গলবাড়িতে রাজ্য পরিচালনা করে আসছিলেন। বীর ঈশা খাঁ তাই জঙ্গলবাড়ী দুর্গটিকে অধিগ্রহণের জন্য সেখানে অভিযান চালিয়ে তাকে পরাজিত করেন এবং তথায় স্বাধীন বৃহত্তর ভাটি রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। সেই ঐতিহাসিক জঙ্গলবাড়ী দুর্গের প্রাচীন স্থাপত্য আজ আর তেমন অবশিষ্ট নেই। মূল দুর্গের বাহিরে সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে বা এর পরের যে স্থাপনাগুলো আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাবেলীর অভ্যন্তরের প্রাচীন কোনো স্থাপত্য মাটির ওপরে অবশিষ্ট নেই। তবে প্রত্নতত্ত অধিদপ্তর কর্তৃক বাড়িটি সংরক্ষিত হওয়ার পরে দুর্গ এলাকাকে পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত মসজিদ ও দরবার হলটিকে পুর্বের আদলে সংস্কার করা হয়েছে। বসতভিটার পুরনো দালানটিও সংস্কারের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রায় ১০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন করে সংস্কার কাজ চলমান রেখেছে। ঈশা খাঁ স্মৃতি জাদুঘরে রুপান্তরের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।
ঈশা খাঁ’র ১৪ তম পুরুষ দেওয়ান আমিন দাদ খাঁ’র ছেলে সাবেক সেনা সদস্য দেওয়ান মামুন দাদ খাঁ বলেন, হাবেলী দুর্গের অভ্যন্তরের দালানগুলো ১৩১৬ সনের ঘূর্ণিঝড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। দুর্গ এলাকায় অনেক ভবনের ধবংসাবশেষ ও পুরনো দালানের অংশ বিশেষ মাটির নীচে আজও দেখা যায়। জঙ্গলবাড়ী দুর্গ অভ্যান্তরে কি ধরনের প্রাচীন স্থাপত্য ছিল তাঁর সন্ধান পাওয়া যাবে যদি সমগ্র দুর্গ এলাকাটি খনন কার্য করা হয়। বীর ঈশা খাঁ’র সহায় সম্পদগুলোকে রক্ষা করতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে চায় যেভাবে ঈশা খাঁ ঘোড়ায় চড়ে সম্পদের রক্ষনাবেক্ষণ করতেন সেভাবে আমিও তাঁর সম্পদগুলো উদ্ধারে নামি। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মহাবীর ঈশা খাঁ’র স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়িটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করেছে। প্রায় ১০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন করে সংস্কার কাজ চলমান রেখে জাদুঘরে রুপদানে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। ঈশা খাঁ ভক্ত অনুসন্ধানী লেখক আমিনুল হক সাদী ভাইয়ের প্রচেষ্ঠায় ২০০৫ সালে বাবার প্রতিষ্ঠিত বীর ঈশা খাঁ’র নামে একটি পাঠাগার নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলছেন। এতে করে আগামী প্রজন্ম ঈশা খাঁকে সহজে চিনতে ও জানতে পারবে এবং গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। এ পাঠাগারের আয়োজনে প্রশংসনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তাঁর ্এই উদ্যোগকেও ঈশা খাঁ পরিবারের পক্ষ থেকে স্বাগত জানাই।
কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলায় রয়েছে এসারসিন্ধুর দুর্গ। এ দুর্গটিতে বাংলার বার ভূইয়াদের প্রধান মসনদণ্ডই-আলা বীর ঈসা খাঁ’র একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। এ স্থানেই মুঘলদের সাথে তিনি অসম সাহসিকতার মাধ্যমে লড়েছিলেন এবং মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহকে পরাজিত করেছিলেন। দুর্গ প্রাচীর কেটে পরিখাগুলো ভর্তি করে সেখানে জমি ও বাড়ী ঘর তৈরি করা হয়েছে। সমস্ত দুর্গ এলাকায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রাচীন ইট পাথরের ভগ্নাংশ। দুর্গের ভেতরে প্রাচীন জলাশয় রয়েছে। দূর্গটিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খনন চালিয়ে অনেক প্রত্নবস্ত আবিষ্কার করেছে। ঈশা খাঁ’র দুর্গ নগরের পার্শ্বেই গরিবুল্লাহ শাহ নামক একজন সাধকের কবরসহ অজানা বহু কবর রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এগারসিন্দুর দুর্গ এলাকাটি খুবই সুন্দর যা পর্যটনের জন্য অনুকূল পরিবেশ। এছাড়াও সারা দেশে বীর ঈশা খাঁ ও বার ভূঁইয়াদের অনেক স্মৃতি রয়েছে।
Leave a Reply